ভোটের পরপরই চালের ‘জ্বর’ বাড়তে শুরু করেছে। প্রথমে মনে হয়েছিল ভোটের তালে রাস্তা রুখে দেওয়ায় ট্রাক পরিবহন সাময়িক বন্ধ ছিল, এ কারণে সরবরাহের শিকলে টান পড়েছে। এখন ভোট শেষ। সবকিছু কবজায়। কিন্তু চালের দাম বাড়ছে। ভোটের হাওয়া বইবার আগে আমন ধানে বাজার সয়লাব হয়েছিল। আবহাওয়া বিরূপ না থাকায় বাম্পার ফলন ছিল। কিন্তু চাষি ধানের দাম পাননি। হাটে হাটে ঘুরেও চালান ওঠেনি তাঁর।
বগুড়ার আদমদীঘির ছাতিয়ানগ্রামের হাটে গত ২০ নভেম্বর ধানচাষি কদম সরকার গিয়েছিলেন ধান বেচতে। তাঁকে সেদিন বাধ্য হয়ে এক মণ ধান ৬৫০ টাকায় বেচতে হয়েছিল। তাঁর মতো প্রায় সব চাষিকেই তখন কম দামে ধান বেচতে হয়েছে। তখন দেশের নানা হাটবাজারে নতুন আমন ধান বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬৫০ থেকে ৬৯০ টাকায়। অথচ ২০১৭ সালের একই সময় আমন ধান বিক্রি হয়েছিল ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকায়। সেটাও কিন্তু তেমন লাভজনক ছিল না। এক মণ ধান ফলাতে কৃষকের কমবেশি ৮০০ টাকা খরচ হয়।
ধানের বাজার মন্দা কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সংবাদকর্মীরা দেশের অন্যতম ধান উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ এলাকা নওগাঁর ধান ও চাল পাইকার সমিতির সভাপতি নীরদ বরণ সাহার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি সেদিন জানিয়েছিলেন ধানের অতিরিক্ত ফলন হয়েছে। আড়তে–গোলায় ধান রাখার জায়গা নেই। তাই পাইকারেরা আর কিনছেন না। তা ছাড়া সরকার রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ৩৮ লাখ ৯২ হাজার টন চাল আমদানি করে সব গুদাম–আড়ত ভরে ফেলেছে। এখন ক্রেতা নেই, তাই দাম নেই। অর্থনীতির সহজ পাঠ—সরবরাহ বেশি, চাহিদা কম— তাই দাম কম। এতে পাইকারদের কী করার আছে? তাঁরা পুতুলমাত্র, বাজারের দাস। নীরদ বরণ সাদামাটা ভাষায় সেটাই বলেছিলেন।
বাজার অর্থনীতিতে বাজার চলে বাজারের গতিতে। যেমন ‘আইন চলে আইনের গতিতে’। দুষ্ট লোকেরা যদিও বলেন, এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে আইন চলে পুলিশের হাত ধরে, যেমন পুঁজিবাদী বাজার চলে পুঁজির হাত ধরে। আমাদের ধান–চালের পুঁজির মালিক আড়তদার, পাইকার আর তাঁদের রাজনৈতিক দোসররা। ফলে তাঁদের হাতেই বাজার।
আমনের আগে আউশ, বোরো দুটোর ফলনই ভালো ছিল ২০১৮ সালে। আগের বছরের (২০১৭) হাওর ট্র্যাজেডির ধকল দেশ কাটিয়ে ওঠে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা প্রান্তিক কৃষক আর ভাগচাষিদের পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী প্রচেষ্টায়। প্রকৃত উৎপাদক তঁারাই। বলা বাহুল্য, কথিত বাজার অর্থনীতির উৎপাত সামলানোর কোমরের জোর তাঁদের নেই। মাড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ধান বেচতে না পারলে তাঁদের ভাত জোটে না। যে ধারদেনা করে তাঁরা জমি বর্গা রাখেন, সার নেন, বীজ, কলের লাঙল, পানি, নিড়ানি কীটনাশকের দাম মেটান; তা সুদে-আসলে শোধ করতে হয় ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। এই সহজ হিসাবটা ধানের মূল ক্রেতা আড়তদার-পাইকারেরা জানেন বলেই ধান উঠলে তাঁরা হাত গুটিয়ে নেন। চাষি বাধ্য হন কম দামে ধান ছেড়ে দিতে। লোকসানি দামে না বেচে হাট থেকে ধান বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো গাড়িভাড়াও তাঁর থাকে না। তাঁকে আড়তদারের হাওলায় রেখে যেতে হয় রক্ত-ঘামে ভেজা ধান।
এসব কি শুধুই ভবিতব্য ভাগ্যের লিখন, না এর মধ্যে কোনো কারসাজি আছে? লোকসানি দামে ধান বেচে বেশি দামে চাল কিনতে হবে কেন কৃষককে? দেশের সব প্রান্তে একই সঙ্গে একইভাবে হঠাৎ কেন দাম বাড়বে চালের? ঢাকার পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, নির্বাচনের তিন দিন আগে পরিবহনব্যবস্থায় কড়াকড়ির কথা বলে চাল সরবরাহ বন্ধ রেখেছিলেন মিলাররা। নির্বাচনের পর চাল সরবরাহ শুরু হলেও মিলগুলো থেকেই প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) দুই ধাপে ১০০ টাকা করে দাম বাড়ানো হয়েছে। কারওয়ান বাজার, মিরপুর ১, উত্তর বাড্ডা, সাতারকুল পাইকারি বাজার, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, বরগুনা সব জায়গায় একই কাহিনি। পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি দুই টাকা বাড়ায় খুচরা ক্রেতাকে কেজিপ্রতি চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে।
তিন তিনটা ভালো ফসলের রেকর্ড আর যথেষ্ট আমদানি মজুত থাকার পরও এবার দাম বাড়া শুরু হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগে। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার এক খুচরা বিক্রেতা জানালেন, আড়তদার, পাইকার বলেছেন ıধরে ধরে বেচতে, বাজারে টান আছে। তার মানে দাম আরও বাড়বে। কৃষিতে ভর্তুকির কথা বেতার, তার, কাগজে, টিভিতে আর বাজেট বক্তৃতায় হামেশাই শোনা যায়। কিন্তু এর কতটুকু আসল চাষির কাছে পৌঁছায় তার হিসাব কেউ দিতে পারবে কি? বেচার সময় দাম না পাওয়া চাষি চাল কেনার সময় কোনো ভর্তুকি পান কি?
আসল চাষির তো বলতে গেলে জমিই নেই। তিনি জমি নেন নগদ টাকায় সনভিত্তিক বরাদ্দ। জমির মালিকের হাতে আগাম টাকা না দিলে জমি তিনি পান না। তেভাগার দিন এখন জাদুঘরে। ফসল হোক না হোক, জমির মালিকের হক তাঁকে আগাম আদায় করতে হয়। আবার ভর্তুকি, সহজ শর্তের ঋণ, সার, বীজ, অনুদান সহযোগিতা সবই যায় জমির মালিকের কাছে। যাঁর জমি নেই কিন্তু হাড়ভাঙা পরিশ্রমে চাষ করেন, তাঁকে দেখার কোনো চশমা নেই সিদ্ধান্তের মালিকদের কাছে।
এখনো দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৬ ভাগ কৃষিতেই যুক্ত, তারপরও আনুপাতিক হারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ প্রতিবছর ধাপে ধাপে কমছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ২ দশমিক ২ শতাংশ ছিল এই মন্ত্রণালয়টির জন্য। ২০১৭-১৮–তে বাজেটের মাত্র ৩ দশমিক ১২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়ের জন্য।
অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কৃষির জন্য বরাদ্দ মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ। আমাদের পেঁয়াজ, রসুন, আদা, তেল, চালের ঘাটতি হলে আমরা যে বন্ধুর দিকে হাত বাড়াই, সেই ভারতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কৃষি ও পল্লি উন্নয়নের জন্য বাজেট বৃদ্ধি করা হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। নতুন মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক নিশ্চয় একবার চেষ্টা করবেন কৃষির আসল চালিকাশক্তি প্রান্তিক চাষির মুক্তির জন্য কম দামে ধান বেচে বেশি দামে চাল কেনার দুষ্ট চক্র ভাঙতে।
গওহার নঈম ওয়ারা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী