২০১১ সাল। তখন আমি এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা পিডিয়াতে পার্টটাইম কাজ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে কার্জন হল হয়ে এশিয়াটিক সোসাইটিতে যাই। সোসাইটির ফটকের সামনেই এক নারীকে প্রায়ই বসে থাকতে দেখতাম। বয়স ৩০-৩৫ মনে হতো। হয়তো এর বেশি কিংবা কম। সেই নারীর হাতে একটা লাঠি থাকত। সেটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উনি কী সব বলতেন। আনমনে কথা বলতেন। কখনো দেখতাম বসে বসে পাউরুটি খাচ্ছেন, হাসছেন। আবার কখনো দেখতাম সামনে কেউই নেই কিন্তু অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ করে বকা দিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতেন। আমিও হাসতাম। লোকে তাকে ‘তারা’ পাগলি বলে ডাকত। লোকজন থেকেই শুনছিলাম তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। অনেক দিন ধরেই নাকি ওই এলাকায় আছেন। সারা দিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান, কিন্তু রাত হলেই এখানে চলে আসেন, রাস্তার ওপরে চট বিছিয়ে ঘুমান। সেই রাস্তা দিয়ে আমার প্রাত্যহিক আসা যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল সেই তারার পেটটি খুব উঁচু। বুঝলাম তারা গর্ভবতী। এটি জানার পর সেই রাস্তা দিয়ে যতবার যেতাম, আমার চোখ তারাকে খুঁজত। তারাকে দেখি। আমাকে দেখে তারা আগের মতোই হাসে, কী সব বলে। কিন্তু আমি আর হাসতে পারি না। ততক্ষণে তারার হাসি আমার মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে। তারার হাসির অনুবাদ আমার কাছে তত দিনে অন্য রকম হয়ে গেছে। তারার হাসি আমার কাছে এই সমাজ সংসারকে ব্যঙ্গ করার। সভ্যতার চরম অসভ্যতার চিহ্ন আমি যেন দেখতে পেতাম তারার সেই হাসির মধ্যে। হয়তো তারা সেই হাসি দিয়ে প্রতিবাদ করছিল সমাজে জারি থাকা ক্ষমতাগুলোর। তারাকে দেখার তাগাদা বেড়ে যায়। কিন্তু সপ্তাহ না ঘুরতেই তারাকে আর সেখানে দেখি না। সেই সন্তানসহ তারার ভবিষ্যৎ কী হয়েছে, সেটি আর জানতে পারি না। আমার মনে কিছু প্রশ্ন স্থায়ী রেখেই তারা আমার দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। তারা আমার দৃষ্টিসীমার কোথাও নেই। তারা তবে কোথায় গেল? আমি আর জানতে পারিনি।
আরও চার বছর পর, তারা তখন আমার স্মৃতিতে খুব বেশি আলো জ্বেলে নেই, সেই তখন ২০১৫ সালে উঁচু পেটসমেত তারা আবারও আমার চোখের সামনে হাসতে থাকে। তারারই মতো আরেকজনের খবর জানতে পারি পত্রিকার মাধ্যমেই। চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের বাদামতলী মোড় এলাকায় আরেকজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী রাস্তায় সন্তান প্রসব করেন। রাস্তা থেকে সেই নবজাতককে উদ্ধার করে লালনপালন করেন তৎকালীন ডবলমুরিং থানার এসআই পল্টু বড়ুয়া। তাঁর এই মানবিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক দেওয়া হয়। সবই পত্রিকা মারফত জানা। কিন্তু এখনো আমার সামনে হাসতে থাকে তারা। কারণ এই মানসিক ভারসাম্যহীন নারীরা যার ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়েছেন, সেই ধর্ষককে খোঁজার তাগাদা কারও ছিল না।
গতকাল প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে অনেকটা সময় ধরেই ঝুলছিল আরেক মানসিক ভারসাম্য নারীর সন্তান প্রসবের খবর। কিন্তু সেই সংবাদেরও মূল জায়গায় ছিল আরেক এসআইয়ের মানবিক গুণাবলি প্রকাশের খবর। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী শীতের রাতে ফুটপাতে নালার পাশে যখন প্রসবযন্ত্রণায় ছটফট করছেন এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী, তখন সেটি দেখতে মানুষের ভিড় লেগেছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। কারণ, সমাজের কাছে তাঁর কদর নেই। সবাই তাঁকেও হয়তো তারার মতো ‘রোজিনা আক্তার’ হিসেবে চেনে। চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহমান আসেন এবং দ্রুত মা ও শিশুকে নিয়ে যান হাসপাতালে। এবং এখনো সেখানেই আছেন মা এবং নবজাতক। হ্যাঁ, এখনো চিকিৎসক, নার্সদের পাশাপাশি তাদের দেখভালের দায়িত্বে আছেন মাসুদুর রহমান। মাসুদুর রহমানের বরাতে আরও জানতে পারি, যেহেতু রোজিনা আক্তার নামের সদ্য মা হওয়া মেয়েটির থাকার কোনো জায়গা নেই, তাই তিনি মনে করছেন আরও কিছুদিন হাসপাতালে থাকাই তাঁর আর তাঁর সন্তানের জন্য মঙ্গল হবে।
প্রকাশিত সংবাদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার পর আমি আরও জানতে পারি, তারার মতো তাঁর অতি নগদ ইতিহাস পাবলিক মেমোরির মতো লোকজনের মুখ মুখে। রোজিনা আক্তার তিন বছর ধরে আগ্রাবাদ এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন। সবাই জানেন, দিনের বেলায় এদিক-ওদিক থাকেন তিনি। কিন্তু সন্ধ্যার পরই চলে আসেন চালহীন ডেরায়, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনের ফুটপাতে।
তারা আর রোজিনা যখন আমার সামনে ঘুরছে, তখন খোদ আরেকটি সংবাদও আমার চোখে পড়ে। আর সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যের ফিনিক্স পুলিশ শনিবার এক যৌন হামলার তদন্ত শুরু করেছে, কারণ এই যৌন হামলাটি হয়েছে এমন একজন নারীর ওপর যিনি হাসপাতালে ১৪ বছর ধরে কোমায় আছেন এবং তিনি গত ২৯ ডিসেম্বর সন্তানের জন্ম দেন। তার মানে হলো, এই কোমায় থাকা নারীকেও কেউ না কেউ ধর্ষণ করেছে, নিপীড়ন করেছে।
শুধু দূরত্বের দিক থেকেই নয়, বিভিন্ন দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান একে অন্যের বহু দূরে। কিন্তু ধর্ষণের যে মনস্তত্ত্ব, সেদিক থেকে হয়তো দুটো দেশই এক কাতারে। যুক্তরাষ্ট্রে যেহেতু ফিঙ্গার প্রিন্ট এবং ডিএনএ টেস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট রয়েছে, সেখানে হয়তো ধর্ষক অচিরেই শনাক্ত করা যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সমাজ ও আইন অনুযায়ী ধর্ষকেরা জানে, মানসিক ভারসাম্যহীন কাউকে ধর্ষণ করলে এর কোনো বিচার হবে না নিশ্চিতভাবেই। কারণ, আইন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের কোনো ধরনের মামলা গ্রহণ করে না এবং তাদের সাক্ষ্যও আইনের কাছে গ্রহণীয় নয়। তাই সব দিক বিবেচনায় মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে ধর্ষণ করা অনেক বেশি নিরাপদ। এতে বিচার, আইন-আদালতের ঝুঁকি পোহাতে হবে না।
আমরা সেই আইনের দিকে ফিরে তাকাতে চাই না, যেখানে একজন মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন নারী বিচার পাবে না, ধর্ষণের শিকার হলেও সেই নারী বলতে পারবে না। আমরা শ্রদ্ধা ভরে মনে রাখার চেষ্টা করি পল্টু বড়ুয়া কিংবা মাসুদুর রহমানকে তাঁদের কর্তব্য পালনের জন্য, মানবিক অনুভূতিকে জিইয়ে রাখার জন্য। এর পাশাপাশি আমরা কি কখনো চিন্তা করি, কীভাবে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী এই সমাজে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ হয়ে যায়। কারণ আইন, সমাজ, রাষ্ট্র সেটির অনুমোদন দেয়। আমার-আপনার আশপাশের মানুষের মুখোশ পরা কোনো ধর্ষকই হয়তো এই সন্তানের বাবা। যুদ্ধ বা দাঙ্গা ছাড়া বেশির ভাগ ধর্ষণের ক্ষেত্রেই ধর্ষকের পরিচয় জানা সম্ভব। শুধু এ ক্ষেত্রে সম্ভব হলেও ধর্ষণের শিকার নারী নাম-পরিচয় বললেও আইন বা সমাজ সেটিকে গ্রহণ করে না, কারণ রাষ্ট্রীয় আইন তাঁর কথা মানবে না। কারণ তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। মানবিক বোধকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি এই ধর্ষকদের খুঁজে বের করা জরুরি। কারণ এই ধর্ষকেরা আমার আর আপনার পাশেই আছে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।