ব্যাপক ভাংচুর, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া * বিজিবি মোতায়েন কারখানা ছুটি * এক মাসের মধ্যে সমস্যা সমাধান -বাণিজ্যমন্ত্রী
ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিতকরণ ও অপারেটর-হেলপারের মধ্যে বেতনবৈষম্য দূর করার দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে চতুর্থ দিন বুধবার রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন পোশাক শ্রমিকরা।
বিভিন্ন যানবাহনে তারা ব্যাপক ভাংচুর চালায়। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত করতে গেলে তারা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। বেশকিছু কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক মাসের মধ্যে গার্মেন্ট শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।
বুধবার সকাল থেকে রাজধানীর কালশী, উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকার সড়কে অবস্থান নিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। সকাল ৯টার দিকে ২২তলা গার্মেন্টের সামনে জড়ো হয়ে তারা বিক্ষোভ শুরু করে। এরপর তারা সড়কে অবস্থান নিলে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তবে দুপুর ১টার দিকে পুলিশের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেয়। পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ইমরানুল হাসান প্রিন্স জানান, শ্রমিকরা সকাল থেকে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করছিল। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মালিকদের আশ্বাসে দুপুর ১টার দিকে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ তুলে নেয়। উত্তরখান ও দক্ষিণখানের বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সকালে বিমানবন্দরের সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করে। তবে পুলিশের বাধায় তারা প্রধান সড়কে আসতে পারেনি।
আশুলিয়া প্রতিনিধি জানান, সাভার ও আশুলিয়ায় বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক কারখানাগুলোর সামনে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে বেশ কয়েকটি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
সকাল ৯টার দিকে সাভারের হেমায়েতপুর ও আশুলিয়ার কাঠগড়ায় শ্রমিক ও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একই সময়ে নিশ্চিন্তপুর ও নরসিংহপুরের হা-মীম গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, অনন্ত গ্রুপ, সোনিয়া গার্মেন্ট, নিট এশিয়া, ট্রাউজার লাইনস, জনরণ লিমিটেড এবং ম্যাগপাইসহ ২০টি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সড়কে নেমে যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়। ৮-১০টি যানবাহন ভাংচুর করে। তাদের ঠেকাতে পুলিশ মারমুখী হলে শ্রমিকদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ টিয়ারশেল ও ব্যাপক লাঠিচার্জ করে শ্রমিকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
স্থানীয়রা জানান, আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে সকালে রাস্তায় নেমে পড়ে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত তারা সড়ক অবরোধ করে রাখে। বেরন সরকার মার্কেট, ছয়তলা, জামগড়া, শিমুলতলা ও ইউনিক এলাকার ৩০টির বেশি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ২৫-৩০টি যানবাহনে ভাংচুর করে। শিমুলতলা এলাকায় শ্রমিকরা রাস্তায় বড় বড় পাথর ও ময়লার বস্তা ফেলে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
সকাল থেকে ওই এলাকার সেড ফ্যাশন, উইন্ডি গ্রুপ, স্টার্লিং অ্যাপারেলস, স্টার্লিং স্টাইল, স্টার্লিং ক্রিয়েশন, সেতারা গ্রুপ, মেডলার অ্যাপারেলস, বান্দো ডিজাইন, এএম ডিজাইন, এনভয় গ্রুপ, ডিজাইনার জিন্স, দ্য রোজ ড্রেসেস, ডেকো গ্রুপ, হিয়ন অ্যাপারেলস, দ্য ড্রেস আইডিয়াস এবং পলমল গ্রুপসহ ৩০টি কারখানার ২০ সহস্রাধিক শ্রমিক বিক্ষোভ করে। তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের লাঠিচার্জে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
সকাল ১০টায় স্টার্লিং অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা উৎপাদন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করে। কর্মকর্তাদের রক্ষায় ওই কারখানার আয়রনম্যান শাহিন এগিয়ে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাকে মারাÍক আহত করে।
এ সময় বেশ কয়েকজন শ্রমিক আহত হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় শাহিনকে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া আহত শ্রমিকদের বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এদিকে শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার মেট্রো ফ্যাশন অ্যান্ড ডাইং ও নিউ এশিয়া এবং সাভারের স্ট্যান্ডার্ট গ্রুপের সামস স্টাইল ওয়্যার লিমিটেডসহ কয়েকটি কারখানা বুধবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আশুলিয়া থানার পরিদর্শক জাভেদ মাসুদ বলেন, শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘটনায় কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি।
এদিকে সাভারের উলাইল ও হেমায়েতপুর এলাকার আল মুসলিমসহ বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। তারা সড়ক অবরোধ করে যানবাহন ভাংচুর করে। এতে বাধা দিলে তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। শ্রমিকদের ওপর দফায় দফায় টিয়ারশেল ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় পুলিশসহ ১৫ জন আহত হন। এ বিষয়ে শিল্প পুলিশ-১ এর পরিচালক সানা শামীনুর রহমান জানান, পোশাক কারখানাগুলোয় কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
একই ইস্যুতে গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ এবং যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনার পর বিভিন্ন স্থানে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানান, পোশাক শ্রমিকদের বিশৃঙ্খলা রোধে টঙ্গী, গাজীপুরা, হোতাপাড়া, কোনাবাড়ী ও মৌচাক এলাকায় চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বুধবার সকাল থেকে বিজিবি সদস্যরা টহল দিচ্ছেন।
ধামরাই প্রতিনিধি জানান, পলমল গ্রুপের নাফা অ্যাপারেলস গার্মেন্টের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে কারখানার সামনে বিক্ষোভ করে। এরপর তারা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। এতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ধামরাইয়ের ইসলামপুর থেকে বারবাড়িয়া পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। এ মহাসড়কসহ ১৪টি সংযোগ সড়কে যানবাহন চলাচল দুই ঘণ্টা বন্ধ হয়ে যায়। তবে পুলিশের আশ্বাসে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেয়। এদিকে কয়েকটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।
এ ব্যাপারে নাফা অ্যাপারেলস গার্মেন্টের জিএম মাহমুদ বিন সামাদ জানান, বেতনভাতায় বৈষম্য না থাকলেও আমাদের কারখানার শ্রমিকরা কী কারণে আন্দোলন করছে তা জানি না। শ্রমিকদের কাজে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়েছে। একদিনের জন্য কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ধামরাই থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা জানান, ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
ফতুল্লা প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চল ফতুল্লায় শ্রমিকদের আন্দোলনে উসকে দিতে একটি লিখিত কাগজ বিলি করা হয়েছে। অথচ কাগজে কারখানার নাম-ঠিকানা, মালিকের স্বাক্ষর বা সিল নেই। বুধবার বিসিক অঞ্চলে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে এ কাগজ বিলি করা হয়। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। শিল্প পুলিশের এসপি জায়েদুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে আমরা কঠোর নজরদারি রাখছি। বিসিক এলাকায় পুলিশের কড়া পাহারা বসানো হয়েছে। কেউ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করলে ছাড় দেয়া হবে না।
সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ওয়েস্ট নিট ওয়্যার লি. ও পিএম নিট টেক্সটাইলের শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। খবর পেয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ও শিল্পাঞ্চল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আদমজীর সুমিলপাড়ার ওয়েস্ট নিটওয়্যার এবং বেলা ১২টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত গোদনাইলের পিএম নিট টেক্সটাইল কারখানার শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জ-আদমজী-ডেমরা সড়ক অবরোধ করে।
শ্রমিকদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া অধিকাংশ সময় তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। এমনকি অহেতুক তাদের ছাঁটাইও করেন। শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পুলিশ দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা শান্ত হয়। কারখানার সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এক মাসের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস : এক মাসের মধ্যে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি শ্রমিকদের ধৈর্যধারণ করে কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ আশ্বাস দেন। নতুন বেতন কাঠামোর কারণে কোনো শ্রমিকের বেতন কমলে তা আগামী মাসের বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিশোধ করা হবে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, নতুন বেতন কাঠামোর অসঙ্গতি দূর করতে শ্রমিক পক্ষের পাঁচজন, মালিকপক্ষের পাঁচজনসহ শ্রম ও বাণিজ্য সচিবের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কাজ করবে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতনের বিষয়ে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। তিনি বলেন, প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও কারখানা ভাংচুর কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের আন্দোলনে অনেক সময় বাইরের লোক ঢুকে যায়। সে বিষয়টি সরকার কঠোরভাবে মনিটর করছে।